হিন্দু পুরাণ মতে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে অন্নপূর্ণা দেবীর পূজা হয়ে থাকে।এই তিথিতে মা অন্নপূর্ণার বিশেষ পুজো (Annapurna Puja at home) আরাধনা করুন আপনার ঘরে। অন্নপূর্ণা দেবী অন্ন প্রদান করেন এবং তিনি সকলের দুঃখকষ্ট নিবারণ করেন।
মা অন্নপূর্ণা হলেন দ্বিভুজা, তার এক হাতে অন্ন এবং অন্য হাতে হাতা। দেবী পার্বতীরই এক রূপ হলেন দেবী অন্নপূর্ণা। ক্ষুধার্থ এবং ভিক্ষারত মহাদেবকে অন্ন প্রদান করে দেবী পার্বতী দেবী অন্নপূর্ণার নাম পেয়েছিলেন।
Table of Contents
মনে করা হয় যে গৃহে দেবী অন্নপূর্ণার পুজো করা হয় সেই গৃহে কখনও অন্নাভাব হয় না। বাংলায় অন্নপূর্ণা পুজো শুরু করেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বজ ভবানন্দ মজুমদার। আবার অনেকে বলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের হাত ধরেই বাংলায় অন্নপূর্ণা পুজোর সূচনা হয়।
ঘরোয়া অন্নপূর্ণাপূজার (Annapurna Puja at home) পদ্ধতি
ঘরোয়া অন্নপূর্ণাপূজার উপকরণ
- চাঁদমালা, দুটো পৈতে, সিদ্ধি, আতপ চাল, সিঁদুর, মধু, পঞ্চশস্য, ঘি, দুধ, চারটি সুপোরি, দুটো পান, গঙ্গামাটি অথবা ফুল গাছের তলার মাটি, গঙ্গাজল না থাকলে পরিষ্কার টেপের জল। ।
- মুগডাল, আলু, পটল, বেগুন, কুমড়ো।
- ঘট, গামছা, সিস্ ডাব, দুই জোড়া শাঁখা-পোলা, আলতা, শাড়ি, লাল রঙের ওড়না।
- মিষ্টি, চিড়ে, বাতাসা, নাড়ু।
- আম পল্লভ, লাল জবার মালা, লাল পদ্ম ফুল, বেল ফুলের মালা, অন্য ফুল, বেলপাতা।
অন্নপূর্ণা পূজার আচমন পর্ব
পুজোতে বসার আগে নিজের মাথায় এবং পুজোর সব উপকরণে গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিতে হবে। হাতে সামান্য গঙ্গা জল নিয়ে আচমন করে নিতে হবে।
বিষ্ণুমন্ত্র:-
ওঁ তদবিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি স্বরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরাততম্ !!
ওঁ অপীবত্র: পবিত্রো বা সর্বাবস্থ্যাং গতোহপি বা।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরশুচীঃ ।।
একটা পাত্রে গঙ্গা জলের সঙ্গে লাল চন্দন, অগরু আর কপুরের গুঁড়ো মিশিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে। এটা পুজোর ফুল,বেলপাতা, দুর্বা, মালা ইত্যাদির ওপর ছিটিয়ে দিতে হবে।
অন্নপূর্ণা পূজার আসন প্রতিষ্ঠা
প্রথমে মেঝেতে আল্পনা অঙ্কন করে নিতে হবে। অন্নপূর্ণামাকে যেখানে বসাবেন সেখানে একটা আল্পনা অঙ্কন করতে হবে।
একটি পরিষ্কার কাঠের জলচোকির ওপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে একটি লাল কাপড় বিছিয়ে নিতে হবে। এই কাপড়ের ওপর কিছুটা গঙ্গাজল, আতপ চাল এবং ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে নিতে হবে । তারপর আসনের ওপর অন্নপূর্ণামার ছবি অথবা মূর্তি স্থাপন করতে হবে।
অন্নপূর্ণা পূজার দীপ ধুপ জ্বালানো
পুজো শুরু করার আগে একটি ঘিয়ের প্রদীপ এবং তিনটি ধূপকাঠি ধরিয়ে নিতে হবে। অন্নপূর্ণামা যেহুতু মা দুর্গার একটি অন্য রূপ। মাদুর্গার মাটির প্রদীপ খুব প্রিয়, তাই পুজো শুরু করার আগে একটি ঘি দিয়ে মাটির প্রদীপ জ্বালালে মা খুব প্রসন্ন হন।
অন্নপূর্ণা পূজার স্নানাভিষেক
একটি পরিষ্কার সুতির কাপড়ে সামান্য গঙ্গাজল, সামান্য গোলাপজল এবং কিছুটা অগরু নিয়ে অন্নপূর্ণামার ছবিটি সুন্দর করে মুছে নিতে হবে। আর যদি ঘরে প্রতিষ্ঠিত মূর্তি থাকে তাহলেও একই ভাবে মাকে স্নানাভিষেক করা যাবে। সেই মূর্তি যদি মাটির হয় সেক্ষেত্রে জলশঙ্খের মধ্যে গঙ্গা জল, গোলাপ জল, অগরু, কিছু ফুলের পাঁপড়ি দিয়ে মায়ের মূর্তির সামনে আরতি করার মতো করে ঘোরাতে হবে তিনবার।
অন্নপূর্ণা মাকে সিঙ্গার করা
স্নানাভিষেকের পর অন্নপূর্ণামাকে লাল চন্দনের তিলক, সিঁদুরের ফোটা দিতে হবে। শিবঠাকুরকে সাদা চন্দনের তিলক পরিয়ে দিতে হবে। একটি লাল রঙের ওড়না মার ছবির উপর দিয়ে দিতে হবে। একটি চাঁদমালা একইভাবে মার ছবির উপর দিয়ে দিতে হবে। মহাদেবের উদ্দেশ্যে একটি পৈতে নিবেদন করতে হবে।
ঘট প্রতিস্থাপন
পুজোর ঘটে, সিস্ ডাবে নারায়ণ চিহ্ন অঙ্কন করতে হবে। আম্র পল্লবের প্রতিটি পাতার অগ্রভাগে এবং মধ্যভাগে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে ঘটের মধ্যে রাখতে হবে। ঘটের সুপোরিতে সিঁদুর ফোঁটা দিতে হবে। আমপল্লভ পাঁচটি অথবা সাতটি অথবা নটি পাতাযুক্ত হতে হবে।
ঘটটি জলপূর্ণ করে, তার মধ্যে একটি সুপারি, একটি হলুদের গাঁট, দুর্বা, একটি এক টাকার কয়েন ও সামান্য আতপ চাল দিয়ে দিতে হবে। আম্র পল্লবের প্রতিটি পাতার অগ্রভাগে এবং মধ্যভাগে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে ঘটের মধ্যে রাখতে হবে।
লাল সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে একটি পান পাতা আমপল্লভের উপর রাখতে হবে। পান পাতার বোঁটার অংশটা এই ঘটের মঙ্গল চিহ্ন বরাবর রাখতে হবে।
সিস্ ডাবের উপর গামছা, একটা পৈতে, শাঁখা-পোলা, চাঁদমালা, লাল চন্দন সহযোগে লাল জবার মালা, আর কিছু ফুল, তিনটি দুর্বা তিনটি বেলপাতা দিতে হবে।
সবশেষে গঙ্গামাটি আর গঙ্গা জল দিয়ে একটি ময়াম বানিয়ে তার উপর সিঁদুর ফোটা, পঞ্চশস্য, আতপ চাল, ফুলের পাঁপড়ি, দূর্বা দিতে হবে। তারপর ঘটটি উলো ধ্বনি দিয়ে স্থাপন করতে হবে।
অন্নপূর্ণা পূজার চাল, সিদ্ধি নিবেদন
মাঅন্নপূর্ণা এবং বাবা মহাদেবের উদ্দেশ্যে সিদ্ধি, চাল, ডাল নিবেদন করতে হবে। একটি বাটিতে দুধ, মধু ও কিছুটা ভাং মিশিয়ে বাবা মহাদেবকে নিবেদন করতে হবে।
অন্নপূর্ণা পূজা শুরু
|| নারায়ণাদির অর্চনা ||
প্রতিটি মন্ত্র উচ্চারণ করে হাতে কিছু ফুল নিয়ে ঘটের উপর নিবেদন করতে হবে।
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ নারায়ণায় নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ শ্রীগুরুবে নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ গণেশায় নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ দুর্গায়ৈ নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ শিবায় নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ লাক্সমীদেবই নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ স্বরস্বত্যৈ নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ কার্তিকেয় নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ সর্ব দেবদেবীভ্যনম নমঃ
|| গুরু প্রণাম ||
মন্ত্র উচ্চারণ করে হাতে কিছু ফল নিয়ে হাতজোড় করে নিম্নলিখিত মন্ত্রে ঘটের উপর নিবেদন করতে হবে।
অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তংযেন চরাচরম্।
তৎপদাং দর্শিতাং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।
|| ঘণ্টা পূজা ||
হাতে লাল চন্দন সহযোগে কিছু ফুল নিয়ে নিম্নলিখিত মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজার ঘন্টার উপর ছিটিয়ে দিতে হবে।
ঘণ্টা পূজা মন্ত্র :– ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে জয়ধ্বনি- মন্ত্র-মাতঃ স্বাহা।
|| গণেশ পূজা ||
হাতে লাল চন্দন সহযোগে কিছু ফুল, তিনটি দূর্বা ও বেলপাতা নিয়ে হাতজোড় করে ভগবান গনেশের প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটে নিবেদন করতে হবে।
|| অন্নপূর্ণার ধ্যান মন্ত্র ||
হাতে লাল চন্দন সহযোগে কিছু ফুল, তিনটি দূর্বা ও বেলপাতা নিয়ে হাতজোড় করে নিম্নলিখিত মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটে নিবেদন করতে হবে।
ধ্যান মন্ত্র: “রক্তাং বিচিত্রবসনাং নবচন্দ্রচূড়ামন্নপ্রদান-নিরতাং স্তনভার নম্রাম্। নৃত্যন্তমিন্দুশকলাভরণং বিলোক্য হৃষ্টাং ভজে ভগবতীং ভবদুঃখহন্ত্রীম্।।”
তারপর হাত জোড় করে অন্নপূর্ণার প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে।
প্রণাম মন্ত্র: “অন্নপূর্ণে সদা পূর্ণে শঙ্কর-প্রাণবল্লভে। জ্ঞানবৈরাগ্যসিদ্ধার্থং ভিক্ষাং দেহি নমোহস্তুতে।”
|| অন্নপূর্ণার পূজা মন্ত্র ||
হাতে লাল চন্দন সহযোগে কিছু ফুল, তিনটি দূর্বা ও বেলপাতা নিয়ে হাতজোড় করে নিম্নলিখিত অন্নপূর্ণার পূজা মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটে নিবেদন করতে হবে।
অন্নপূর্ণার পূজা মন্ত্র: “ওঁ সায়ুধায়ৈ সবাহনায়ৈ সালঙ্কারায়ৈ সপরিবারায়ৈ। ওঁ হ্রিং অন্নপূর্ণায়ৈ পরমেশ্বয্যে নমঃ।। ওঁ অন্নপূর্ণায়ৈ দেব্যৈ নমঃ”
|| অন্নপূর্ণার মূলমন্ত্র ||
হাতে লাল চন্দন সহযোগে কিছু ফুল, তিনটি দূর্বা ও বেলপাতা নিয়ে হাতজোড় করে নিম্নলিখিত অন্নপূর্ণার মূলমন্ত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটে নিবেদন করতে হবে।
অন্নপূর্ণার মূলমন্ত্র মন্ত্র: “হ্রীং নমো ভগবতী মাহেশ্বরী অন্নপূর্ণে স্বাহা :”
|| অন্নপূর্ণা পূজার পুষ্পাঞ্জলি ||
হাতে লাল চন্দন সহযোগে কিছু ফুল, তিনটি দূর্বা ও বেলপাতা নিয়ে হাতজোড় করে নিম্নলিখিত অন্নপূর্ণার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র উচ্চারণ করে তিনবার ঘটে নিবেদন করতে হবে।
পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র: “ওঁ অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে শঙ্করা প্রানভল্লভে। জনা ভৈরাগ্যা সিদ্ধারত্যম ভিক্ষ্যম দেহি নমোহস্ততে।।”
|| অন্নপূর্ণা প্রণাম মন্ত্র ||
হাত জোড় করে নিম্নলিখিত প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রণাম জানাতে হবে।
আরতি পর্ব
সাধারণ নিত্য পুজোয় যা যা দিয়ে আরতি করা হয় অর্থাৎ ধূপকাঠি, তেলের পঞ্চপ্রদীপ, ঘিয়ের প্রদীপ, কর্পূর এবং সুগন্ধি ধুনো দিয়ে মা অন্নপূর্ণাকে আরতি করতে হবে।
নিত্যপূজার ক্ষেত্রে এই পাঁচটি জিনিস দিয়েই প্রত্যেকদিন আরতি করা ভালো। প্রতিটি দ্রব্য দিয়ে পাঁচ থেকে সাতবার আরতি করতে হবে।
মা অন্নপূর্ণার কাছে প্রণাম করে নিজের মনস্কামনা নিবেদন করে নিতে হবে। মাকে পূজা গ্রহণ করার জন্য আবেদন করতে হবে এবং পূজার কোন ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।